মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৬:৩৩ অপরাহ্ন
মিনহাজুল ইসলাম মাসুম : সৈয়দ আলী আহসান আমাদের প্রেরণা ও মননশীলতার অনন্য বাতিঘর। জাতীয় চেতনাবোধের আকাশে দীপ্যমান তারকা। পদচারণা ছিল যার কেবল ছাপ্পান হাজার বর্গমাইল নয়, পৃথিবীর দিকদিগন্তে। সতত ভালোবাসা, পরম মমতায় পূর্ণ ছিলো প্রিয় দেশটির জন্য। বেরিয়ে এসেছে দেশপ্রেম ও ভালোবাসার স্মারক ‘আমার পূর্ব-বাংলা’র ন্যায় কালজয়ী কবিতা। যেখানে শোনা যায় পাখির গান, নদীর কলতান, পাতার মর্মর ধক্ষনি, রৌদ্রময় দিবস, স্বপ্নময় রাত্রি, সোঁদা মাটির গন্ধ ও বৃষ্টির রিমঝিম সুরের অনন্য আবেশ। কাক, বক, মাছরাঙা ও গাঙশালিকের কোলাহলে নৈসর্গিকরূপ ফুটে উঠেছে তমাল নীলাম্বরীর স্নিগ্ধতায় কবির প্রিয়তম জন্মভূমি পূর্ব বাংলায়।
‘আমার পূর্ব-বাংলা অনেক রাত্রে
গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দের মতো।
স্বচ্ছ নির্মল গাছের পাতায় মুক্তা
ছোট ছোট ফুল যেন অনেক তারা
যেন বনকন্যাদের চোখের পানি
যেন নিটোল নখের উপর শুক্তির স্বচ্ছতা। ‘
(আমার পূর্ব বাংলা-তিন, একক সন্ধ্যায় বসন্ত)
চল্লিশের দশকের শক্তিশালী কবিদের একজন সৈয়দ আলী আহসান (জন্ম-২৬ মার্চ ১৯২০, মৃত্যু- ২৫ জুলাই ২০০২)। মাগুরা জেলার অন্তর্গত আলোকদিয়া গ্রাম তাঁর জন্মভিটা। তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য সংকলন হচ্ছে আলোচিত এ কাব্যগ্রন্থ ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’। এ কাব্যগ্রন্থে মোট ২৮টি কবিতা রয়েছে। সবগুলো কবিতাই গদ্য-কবিতা। গদ্যছন্দে লিখিত এসব কবিতায় সুনির্দিষ্ট পর্ব বা মাত্রাসাম্য নেই। তবে কবিতায় উপমা ও শব্দ ব্যবহারে নতুনত্ব ও আধুনিকতা বেশ লক্ষণীয়। এ গ্রন্থে কয়েকটি ত্রয়ী কবিতারও সমাবেশ ঘটেছে। তার উপমাগুলোও বিমূর্ত! গ্রন্থে কয়েকটি কবিতা রয়েছে যা বেশ চমৎকার! বিকেল-আকাশের মেঘ, আমার পূর্ব-বাংলা, হৃদয়, উপমা, রবীন্দ্রনাথকে, যখন অনেক কথা বলা শেষ হল, ভাবনাগুলো, বৃষ্টি, ইস্তাম্বুল, ঈদ, প্রার্থনা এবং আধুনিক ফরাসি থেকে ইত্যাদি। এদের মধ্যে ‘আমার পূর্ব-বাংলা’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি সেরা কবিতা বলে বোদ্ধাদের কাছে বিবেচিত।
‘আমার পূর্ব-বাংলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ
অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ………..
এখানে নদীর মতো এক দেশ
শান্ত, স্ফীত কল্লোলময়ী
বিচিত্ররূপিণী অনেক বর্ণের রেখাঙ্কন
এ-আমার পূর্ব-বাংলা
যার উপমা একটি শান্ত শীতল নদী।’’
(আমার পূর্ব বাংলা-এক, একক সন্ধ্যায় বসন্ত)
‘আমার পূর্ব-বাংলা’ নিয়ে বিশিষ্ট কবি ও সমালোচক হাসান হাফিজুর রহমান বলেন,
“(এ কবিতায়) সৈয়দ আলী আহসান অবলীলায় সঞ্চরণের উপযোগী ভিত্তি পেয়ে গেছেন- বিষয়, বক্তব্য এবং বহি:র্প্রকাশের সঙ্গত যোগাযোগ ঘটে গেছে। একটি করে বাক্যে গঠিত এই কবিতা তিনটি। খন্ড খন্ড চিত্রে ও চিত্রকল্পে একটি অখণ্ড রূপকল্পের সৃজন প্রয়াসের মধ্যেই এ কবিতাত্রয়ের আঙ্গিক-স্বাতন্ত্র্য। খন্ডের সমাহারে অষন্ড পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যিক দ্যোতনায় একটি সম্পূর্ণতা আনয়নের প্রয়াসে কবিতা তিনটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা শিহরিত আলোড়ন বয়ে গেছে। কবির মনের গভীরে দেশ সম্পর্কে তাঁর আজীবনের ধারণা, দেশের প্রকৃতি ও মানুষকে দেখার অভিজ্ঞতা, দেশবাসী যেভাবে প্রকৃতি ও জন্মভূমিকে ভোগ করে ও ভালোবাসে, সে সম্পর্কে উপলব্ধি এবং প্রকৃতি ও মানুষের মিশ্রিত জীবন-সংগ্রাম ও ঐতিহ্যলালিত চিরাচরিত মনোভঙ্গি, রসগ্রাহিতা ও আত্ম-উন্মোচনের বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি যেমন করে ছবিতে ও চিন্তায় ধীরে ধীরে সঞ্জাত হয়েছিল, সে সবই যেন এই কবিতায় এক সচ্ছল প্রবাহে একসঙ্গে উৎসারিত।” (আধুনিক কবি ও কবিতা, পৃষ্ঠা-১৬০)
‘প্রার্থনা’ কবিতায় তিনি লিখেন,
“এভাবেই আমার দিন রাত্রির অধীরতা
অনেক বনের মধ্য দিয়ে
অনেক নদী সমুদ্রের স্বচ্ছতায়
একদিন হয়তো পাহাড়ের দুর্গমতায়
পাথরের নিশ্চেতনে সঙ্কট পার হয়
ইউলিসিস ইথাকায় ফিরবে।’
(প্রার্থনা, একক সন্ধ্যায় বসন্ত)
সৈয়দ আলী আহসান বাংলা সাহিত্যের এক বিরাট মহীর“হ। তাঁর লিখিত ও অনূদিত রয়েছে শতাধিক গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য হলঃ বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সাথে যুগ্মভাবে ১৯৫৪), পদ্মাবতী (১৯৬৮), মধুমালতী (১৯৭২), আধুনিক বাংলা কবিতাঃ শব্দের অনুষঙ্গে (১৯৭০), রবীন্দ্রনাথঃ কাব্য বিচারের ভূমিকা (১৯৭৪), মধুসূধনঃ কবিকৃতি ও কাব্যাদর্শ (১৯৭৫), আধুনিক জার্মান সাহিত্য (১৯৭৬), শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য (১৯৮৩), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ (১৯৯৪), আমাদের আত্মপরিচয় এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ (১৯৯৬), জিন্দাবাহারের গলি (১৯৮৫), অনেক আকাশ (১৯৫৯), একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬৪), কখনো আকাশ (১৯৮৪), প্রেম যেখানে সর্বস্ব (১৯৮৭) ও মহানবী (১৯৯৫)। অনুবাদ করেছেন মহাকবি ইকবালের কবিতা (১৯৫২), হুইটম্যানের কবিতা (১৯৬৫), ইডিপাস (১৯৬৮) ও নাহ্জুল বালাগা (১৯৮৮) ইত্যাদি।
সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক মুহাম্মদ মতিউর রহমান বলেন, ”তাঁর অবদানে আমাদের সাহিত্য যেমন সমৃদ্ধ, সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নানা দিক ও বিভাগও তেমনি ঋদ্ধ ও সমুন্নত হয়েছে। এ সকল ক্ষেত্রে তিনি স্বদেশে যেমন বরেণ্য ও সম্মানিত ছিলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তেমনি ছিলেন বিশেষভাবে সমাদৃত।” রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দায়িত্বপালনসহ তিনি একাধারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কবি, সাহিত্যিক, জাতীয় সঙ্গীতের অনুবাদক, বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটিতে ভূমিকা, জাতীয় অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, সমাজ চিন্তক ও প্রাজ্ঞ মনীষা। পেয়েছেন স্বাধীনতা ও একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার।
সৈয়দ আলী আহসান লেখা সামগ্রিক লেখা সম্পর্কে কবি ও প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ নিযামুদ্দিন বলেন, ”তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশ্ব-প্রতিভা। যে অর্থে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজর“ল ছিলেন বিশ্বপ্রতিভা। নিশীথে যে নক্ষত্ররাজি নজরে পড়ে, তাঁদের যেমন কারো সাথে কারো তুলনা চলে না, প্রতিটিই স্ব মহিমায় সমুজ্বল, তেমনি এঁদেরও কারো সাথে কারো তুলনা করে নয়- নিজ নিজ স্বভাব ও সৃষ্টির সৌকর্যে প্রত্যেকেই পৃথক ও প্রোজ্জ্বল। অপরাপর বিশ্ব প্রতিভার ন্যায় সৈয়দ আলী আহসানের বোধ-বিবেচনাও বদ্ধ জলাশয়ের মতো একস্থানে বসে থাকেনি, সাগর-মহাসাগরের আকর্ষণে ছুটে চলেছে দিক-বিদিক।”
আমি সৈয়দ আলী আহসান কবিতা সমগ্র থেকে নিয়ে এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় শামিল হলাম। সমগ্রটি প্রকাশ করেছেন শিখা প্রকাশনী, বাংলা বাজার। মূল্যঃ ৪০০ টাকা। তাঁর বইগুলো বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। এ বিষয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের নজর দেয়ার প্রয়োজন জর“রি বৈকি! ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ আলোচনা করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে কবি সম্পর্কে ও কিছু কথা হয়ে গেল। আশাকরি কাব্যগ্রন্থটি পাঠে সাহিত্যকর্মীরা গভীর দেশপ্রেমসহ নানাবিধ বিষয়ে প্রেরণা পাবেন। ‘আমার পূর্ব-বাংলা’র মতো শ্রেষ্ঠ একটি কবিতার সাথে পরিচিত হয়ে মুগ্ধ হবেন।
তথ্যঋণঃ
১। আধুনিক কবি ও কবিতা-হাসান হাফিজুর রহমান
২। কবিতা সমগ্র- সৈয়দ আলী আহসান (শিখা প্রকাশনী)
৩। অবিনশ্বর- সৈয়দ আলী আহসান সংখ্যা সম্পাদক:ফরিদা হোসেন
আপনার মন্তব্য লিখুন