মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:০০ অপরাহ্ন
এস এম ইরফান নাবিল:
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করতে পারে না বলেই সিডিএকে এ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। কারণ জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশন অযোগ্য।’ বুধবার (৯ আগস্ট) দুপুরে সিডিএর সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
এর আগে গত ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতা সমস্যার বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘জলাবদ্ধতার ভয়াবহ অবস্থা তৈরির জন্য সিডিএ দায়ী। সিডিএ জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নে যোগ্য নয়। কোটি টাকা খরচ হলেও জলাবদ্ধতা নিরসন হয়নি।’
সর্বশেষ ৭ আগস্ট নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজে সিডিএ সমন্বয় করছে না অভিযোগ তুলে ক্ষোভ জানান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নেই। এরপরও মানুষজন সিটি করপোরেশনকে গালিগালাজ করছে। জলাবদ্ধতা নিয়ে গত রবিবার সকালে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন মেয়র। সেখানে তিনি লেখেন, ‘তারা (সিডিএ) করপোরেশনকে কোনও কিছুই জানায়নি। ইচ্ছামতো কাজ করছে। এত বড় একটি প্রকল্প, চট্টগ্রামবাসীর বাঁচা-মরারও প্রশ্ন, এরপরও তারা সমন্বয় করছে না।’
মূলত সিটি মেয়রের এসব বক্তব্যের জেরেই সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে সিডিএ। মেয়রের এমন বক্তব্য সত্য নয় উলেখ করে সংবাদ সম্মেলনে সিডিএর চেয়ারম্যান বলেন, ‘সিডিএ যোগ্য না হলে প্রকল্প দিয়েছে কেন? বরং তারা যোগ্য নয় বলে এই সংশিষ্ট প্রকল্প পায়নি। এবার ভারী বৃষ্টিতেও ডুবেনি চাকতাই-খাতুনগঞ্জ। কারণ সেখানে স্লুইসগেট বসানো হয়েছে। এতে নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে কোটি কোটি টাকার পণ্য। এটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণেই হয়েছে। অতীতে অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যেতো চাকতাই-খাতুনগঞ্জ।’
সংবাদ সম্মেলনে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী বলেন, ‘পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনরায় খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন শীর্ষক সিডিএর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। প্রকল্পের অধীনে নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টির সংস্কার ও সম্প্রসারণের কথা রয়েছে। বাকি ২১টি প্রকল্পের আওতাভুক্ত নয়। ৩৬টি খালের মধ্যে ১৬টির সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। ৯টি খালের কাজ চলমান। বাকি ১১ খালের কাজ শেষ করতে সময় লাগবে। কারণ এসব খালের জমি অধিগ্রহণ শেষ করতে পারেনি সিডিএ। তবে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় এবং ২১টি খাল সংস্কার না করায় সুফল মিলছে না। নগরীতে এক হাজার ৬০০ নালা আছে। এসব নালা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এসব কাজ বাস্তবায়ন হলে সুফল মিলবে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ দিন ধরে জলাবদ্ধ অবস্থায় আছে চট্টগ্রাম নগরী। গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিতে নগরীর বেশিভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়েন লাখো মানুষ। তবে মঙ্গলবার বিকাল থেকে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে। কিছু জায়গা থেকে পানি নেমে গেছে। তবে সাধারণ মানুষের মাঝে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এত টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি না মেলায় সাধারণ মানুষের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে চার প্রকল্পের কাজ চলমান। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনরায় খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক সিডিএর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। ২০১৭ সালের আগস্টে প্রকল্পটির অনুমোদন হয়। পরের বছর কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে; যা অনুমোদনের অপেক্ষায়।
বাকি তিন প্রকল্পের মধ্যে এক হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ‘নগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পাশাপাশি দুই হাজার ৭৪৬ কোটি ৩৯ লাখ ৪৭ টাকায় ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুঘাট সেতু থেকে চাকতাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এ ছাড়া এক হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বহদ্দারহাটের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খননের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিটি করপোরেশন।
টানা বর্ষণে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় চট্টগ্রামে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ধসে পড়েছে শত শত ঘরবাড়ি। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১৩৫ কোটি টাকার। জেলা প্রশাসনের কার্যালয় সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
গত ১ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ৪ আগস্ট নগরী ও জেলায় বন্যা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে। এর মধ্যে ৭ আগস্ট পর্যন্ত চার দিন টানা জলাবদ্ধতা ছিল নগরীতে। অপরদিকে জেলার ১৫ উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলায় এখনও কিছু কিছু এলাকায় বন্যায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। জেলার সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলায় এখনও হাজার হাজার বাড়িঘর পানির নিচে ডুবে ছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলায়।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুলাহ মজুমদার বলেন, ‘বন্যায় চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ১৫ জন পানিতে ভেসে মারা গেছেন। এর মধ্যে সাতকানিয়ায় ছয়, লোহাগাড়ায় চার, চন্দনাইশে দুই, রাউজানে এক, বাঁশখালীতে এক ও মহানগরীতে একজন মারা গেছেন। প্রাথমিকভাবে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩৫ কোটি টাকা।’
তিনি বলেন, ‘জেলার সন্দ্বীপ ছাড়া বাকি ১৪ উপজেলায় কমবেশি বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী।’
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘বন্যায় সাতকানিয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন পানি নামছে। অনেক মাটির ও সেমিপাকা ঘর ধসে পড়েছে। রাস্তাঘাট, কৃষি, মৎস্য, গবাদিপশুর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাতকানিয়ায় এখন পর্যন্ত বন্যায় মারা যাওয়া ছয় জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ আছেন তিন জন। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।’
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শরীফ উল্লাহ বলেন, ‘লোহাগাড়ায় বন্যার পানি অনেকাংশ নেমে গেছে। চার জন মারা গেছেন। তাদের লাশ পাওয়া গেছে। রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি, মৎস্য, সবজি, গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৩০০-৪০০ মাটির ঘর বন্যায় ভেঙে গেছে। তবে কী পরিমাণ এ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা তালিকা করা হচ্ছে।’
সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘এমন ভয়াবহ বন্যা আগে কখনও দেখিনি। এত পানি কীভাবে এলো তা বুঝতে পারছি না। ১৯৯৭ ও ২০১৯ সালেও দুটি বড় বন্যা হয়েছিল। তখন পানি আমাদের বাড়ি পর্যন্ত ওঠেনি। বরং অন্য এলাকার লোকজন আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এবারের বন্যায় আমার বাড়ির ভেতরেও গলা সমান পানি উঠেছে। তবে গত দুদিন বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কমেছে।’
সাতকানিয়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এস ইউনুস বলেন, ‘ভয়াবহ বন্যায় আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ ঘরে পানি ঢুকেছে। কোনও কোনও স্থানে ঘরের চালের ওপর পর্যন্ত পানি উঠেছে। এ কারণে কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে উঠেছে। যারা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যায়নি তারা আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছে। বন্যায় ইতোমধ্যে আমার ইউনিয়নে ৩০০টির মতো ঘর ধসে গেছে। এর মধ্যে দুটি সেমিপাকা বাকিগুলো মাটির ঘর। শুধু আমার ইউনিয়নে তিন জন লোক বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গেছে। এর মধ্যে একজনের লাশ উদ্ধার হলেও দুই জনকে এখনও পাওয়া যায়নি। বর্তমানে পানি কমছে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ১৪টি উপজেলা এবং সিটি করপোরেশনের মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার ১২টি পারিবারের ছয় লাখ ৩৫ হাজার ১৩০ জন লোক বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েন।
এর মধ্যে মীরসরাই উপজেলার চারটি ইউনিয়নের পাঁচ হাজার ৯০ পরিবারের ২০ হাজার ৩৬০ জন, ফটিকছড়ির এক ইউনিয়নের ৯০ পরিবারের ৪৫০ জন, সীতাকুন্ডে ৯ ইউনিয়নের দুই হাজার ৮৬২ পরিবারের ১৫ হাজার ২৬০ জন, হাটহাজারীতে ১৫ ইউনিয়নের ৫০ হাজার পরিবারের দুই লাখ, রাউজানে ১৪ ইউনিয়নের ১৯ হাজার পরিবারের ৭৫ হাজার, রাঙ্গুনিয়ায় ১৫ ইউনিয়নের ২৫০ পরিবারের এক হাজার ২০০, বোয়ালখালীতে ৬ ইউনিয়নের ৫৫০ পরিবারের দুই হাজার ৭৫০, পটিয়ায় ১৮ ইউনিয়নের ১৬ হাজার ৫৯৫ পরিবারের ৫৩ হাজার ৩১০, কর্ণফুলী উপজেলার ৫ ইউনিয়নের এক হাজার ৮৫০ পরিবারের ৯ হাজার ২৫০, আনোয়ারায় ১১ ইউনিয়নের এক হাজার ৪২৫ পরিবারের ৮ হাজার ৫০, চন্দনাইশে ১০ ইউনিয়নের পাঁচ হাজার পরিবারে ২৫ হাজার, সাতকানিয়ায় ১৭ ইউনিয়নের মধ্যে ২২ হাজার ৫০০ পরিবারে ৯০ হাজার জন, লোহাগাড়ায় ৯ ইউনিয়নের চার হাজার পরিবারের মধ্যে ৮০ হাজার, বাঁশখালীতে ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে ১০ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার ৫০০ ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৮০০ পরিবারের চার হাজার জন পানিবন্দি ছিলেন।
আপনার মন্তব্য লিখুন